রাসূলে খোদা (দঃ) হলেন সৃষ্টির প্রথম (২য় পর্ব)
সংকলনেঃ
মাওলানা মোবাশ্বির হোসাইন আল-ক্বাদেরী
এখন জানা দরকার পানির পূর্বে কি সৃষ্টি হয়েছে?
এ সম্পর্কে খোদ রাসুলে খোদা (দঃ) এরশাদ ফরমান-
عَنْ أَبِي هُرَيْرَةَ، عَنِ النَّبِيِّ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ قَالَ: " لَمَّا خَلَقَ اللهُ عَزَّ وَجَلَّ آدَمَ خَيَّرَ لِآدَمَ بَنِيهِ، فَجَعَلَ يَرَى فَضَائِلَ بَعْضِهِمْ عَلَى بَعْضٍ، قَالَ: فَرَآنِي نُورًا سَاطِعًا فِي أَسْفَلِهِمْ، فَقَالَ: يَا رَبِّ مَنْ هَذَا؟ قَالَ: هَذَا ابْنُكَ أَحْمَدُ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ هُوَ الْأَوَّلُ وَالْآخَرُ وَهُوَ أَوَّلُ شَافِعٍ " ... فهذا حديث إسناد رجاله عن آخرهم ثقات. অর্থাৎ;হযরত আবু হুরায়রা রাঃ বলেন রাসুলে মাক্ববুল (দঃ) এরশাদ ফরমান- যখন আল্লাহ রাব্বুল আলামীন হযরত আদম আঃ কে তাঁর সন্তারদেরকে দেখালেন ফলে তিনি পারস্পরিক শ্রেষ্ঠত্ব নিরিক্ষণ করতে লাগলেন। অবশেষে তিনি একটি নূর দেখতে পেয়ে বলেন, হে আমার রব! এই নূর কে? আল্লাহ বলেন,সে তোমার পুত্র আহমাদ! সেই প্রথম সৃষ্ট, সেই শেষ, সেই প্রথম শাফায়াতকারী ও তারই শাফায়াত প্রথম কবুল করা হবে।
সূত্রঃ তারিখে ইবনে আসাকির, শরফুল মোস্তাফা-১ম খন্ড-৪৮৩পৃষ্ঠা, হাদিস নং-২২১৮।
উল্লেখিত হাদিসের সনদ সম্পর্কে আহলে হাদিস ওয়ালাদের মুরুব্বী নাছিরুদ্দীন আলবানী বলেন-
قلت:وهذا اسناد حسن رجاله كلهم ثقات رجال البخارى. অর্থাৎ; আমি আলবানী বলছি এই হাদিসের সনদ হাছান, ইহার সকল বর্ণনাকারীগণ ইমাম বুখারী রঃ এর বর্ণনাকারী।
সূত্রঃ সিলসিলায়ে জয়ীফা-হাদিস নং-৬৪৮২।
অতএব, হাদিস দ্বারা সুস্পষ্টভাবে প্রমাণিত হয়ে গেল রাসুলে খোদা দঃ ই হলেন সৃষ্টির প্রথম এবং আদি পিতা হজরত আদম আঃ সৃষ্টি হওয়ার পূর্বেই তিনি নূর অবস্থায় ছিলেন।নবীয়ে আকরাম দঃ আদম সৃষ্টির পূর্বেই আল্লাহর নূর দ্বারা সৃষ্টি হয়েছেন। কারণ মাটির তৈরী সর্বপ্রথম মানব হলেন হজরত আদম আঃ।
এ ব্যাপারে তাওরাত কিতাবের বড় আলেম বিশিষ্ট তাবেয়ী হযরত কা’ব ইবনে আহবার রাঃ এর অভিমত মুরছাল সনদে হাদিস-
وعن كعب احبار انه قال : قال رسول الله صلى الله عليه وسلم لما اراد الله سبحانه وتعالى خلق المخلقات وخفض الارضين ورفع السموات قبض قبضة من نوره سبحانه وتعالى وقال لها كونى محمد فصارت تلك القبضة عمودا من نور فسجد ورفع راسه وقال الحمد لله فقال الله تعالى لاجل هذا خلقت وسميتك محمدا فبك ابدأ المخلوقات وبك اختم ارسل. অর্থাৎ; হজরত কা’ব আহবার রাঃ বলেন, রাসুলে পাক (দঃ) এরশাদ ফরমান- আল্লাহ রাব্বুল আলামীন যখন জগৎ সৃষ্টি করার ইচ্ছা করলেন (নিচে আসমান ও উপরে যমীন) তখন স্বীয় নূরের ১ম বিচ্ছুরণকে হুকম করলেন: মুহাম্মদ হয়ে যাও । রব্বে তাআলার হুকুমে সে নূরানী বিচ্ছুরণ এক নূরানী সত্বায় পরিণত হয়ে সিজদায় অবনত হলেন। সিজদা থেকে উঠে বললেন, আলহামদুলিল্লাহ।
আল্লাহ পাক ঘোষণা করলেন, এ জন্যেই আপনাকে সৃষ্টি করেছি এবং আপনার নাম রেখেছি ‘মুহাম্মাদ’ আপনার মাধ্যমে সৃষ্টির সূচনা করব এবং আপনার মাধ্যমেই রেছালতের সমাপ্তি ঘোষণা করব।
সূত্রঃ ক. আল-মাওলিদুল আরুছ,কৃত:ইবনে জওজী-১৬ পৃষ্ঠা। খ. নুজহাতুল মাজালিস,১ম খন্ড,২৫২ পৃষ্ঠা,ইবনে আব্বাস সুত্রে।
এই রেওয়ায়েত দ্বারা স্পষ্ট বুঝা যায়, সকল মাখলুকাতের প্রথম মাখলুক বা সৃষ্টি হল হজরত মুহাম্মদ দঃ এবং তাঁর থেকেই সকল মাখলুকাত সৃষ্টি হয়েছে। সুতরাং আমাদের নবী দঃ ছিলেন প্রথম সৃষ্টি।
সর্বোৎকৃষ্ট তাবেঈ ও ইমাম আবু হানীফা রহঃ এর পীর ও উস্তাদ আওলাদে রাসুল দঃ এর অভিমত লক্ষ্য করুন-
قال جعفر الصادق رضى الله عنه أول ما خلق الله نور محمد صلى الله عليه وسلم قبل كل شىء. অর্থাৎ; হজরত জাফর সাদিক রাঃ বলেন-সকল কিছু সৃষ্টির পূর্বে আল্লাহ তা’আলা নূরে মুহাম্মদী সৃষ্টি করেছেন।
সূত্রঃ তাফছিরে রুহুল বয়ান,৮ম খন্ড,৩৯৬পৃষ্ঠা।
এ সম্পর্কে বিশ্ব বিখ্যাত ফকিহ আল্লামা আবুল ফজল হাফিজ ইবনে কাছির (ওফাত-৭৭৪হি:) উল্লেখ করেন-
اخبرنا عبد الوهاب بن عطاء عن سعيد بن ابى عروبت عن قتادة قال: و اخبرنا عمر بن عاصم اكلابى اخبرنا ابو هلال عن قتادة قال قال رسول الله صلى الله عليه وسلم:كنت اولاالناس فى الخلق واخرهم فى البعث.وهذا اثبت واصح.
অর্থাৎ; “রাসুলে খোদা এরশাদ ফরমান সৃষ্টির মধ্যে আমিই প্রথম মানুষ এবং প্রেরিত হয়েছি সবার শেষে। ইহা প্রমাণিত ও অধি সহীহ।”
সূত্রঃ ক.তাবাকাতে কুবরা লি ইবনে সা’দ-১ম খন্ড-১১৯পৃষ্ঠা। খ. আল বেদায়া ওয়ান নেহায়া-১ম খন্ড-৩২৫পৃষ্ঠা। গ. শরফুল মুস্তাফা-২য় খন্ড-৭২পৃষ্ঠা।ঘ. শিফা শরীফ-১ম খন্ড,১১৪ পৃষ্ঠা। ঙ. বাহজাতুল মাহফিল-১ম খন্ড-১৩পৃষ্ঠা।চ. মাওয়াহেবুল লাদুন্নীয়া-১ম খন্ড-৪২পৃষ্ঠা।ছ. শরহে মাওয়াহেব লিয যুরকানী-১ম খন্ড-৬৯পৃষ্ঠা। জ. সুবুলুল হুদা ওয়ার রশিদ-১০ম খন্ড-২৭৪ পৃষ্ঠা। ঝ. শরহে শিফা-১ম খন্ড-১১৭ পৃষ্ঠা।
এ বিষয়ে আল্লামা ইসমাঈল হাক্কী হানাফী রঃ (ওফাত ১১২৭হি:) তদীয় কিতাবে বলেন-
"ان السراج الواحد يوقد منه الف سراج ولا ينقص من نوره شىئ وقد اتفق اهل الظاهر والشهود على ان الله تعالى خلق جميع الشياء من نوره محمد ولم ينقص من نوره شىء".
“নিশ্চয় একটি প্রদীপ থেকে হাজার হাজার প্রদীপ জ্বালালেও ঐ প্রদীপের আলো সামান্যতমও কমেনা। সকল উম্মত বিষয়ে একমত যে, আল্লাহ তা’লা সব কিছুই মুহাম্মদ দঃ এর নূও মোবারক দ্বারা সৃষ্টি করেছেন। অথচ তাঁর নূর মোবারক সামান্যতমও কমেনি।”
সূত্রঃ তাফসিরে রুহুল বয়ান, ৭ম খন্ড,১৯৭ প্র: সুরা আহযাব এর ৪৫-৪৬ নং আয়াতের তাফছির।
আল্লামা হাফিজ ইবনুল হাজ্জ আল-মালেকী রঃ তদীয় কিতাবে বলেন,
فيه ايضا اى فى كتاب شفاء الصدور للخاطيب ابى الربيع وفيه ايضا ان اول ما خلق الله نور محمد صلى الله عليه وسلم فأقبل ذلك النور يتردد و يسجد بين يدى الله عز و جل.
“অনুরুপ আল্লামা খতীব আবী রবিঈ তাঁর ‘সিফাউছ ছিকাম’ গ্রন্থে বর্ণনা করেন, নিশ্চয় সর্বপ্রথম আল্লাহ তা’লা যা সৃষ্টি করেছেন তা হল মুহাম্মদ দঃ এর নূর। অত:পর এ নূর ভূ-কম্পিত হচ্ছলি এবং আল্লাহ তা’লার নিকট সিজদা করছিল।”
সূত্র: আল মাদখাল, ২য় খন্ড,৩২ পৃ:।
বিশ্বখ্যাত মোফাচ্ছির আল্লামা মাহমুদ আলূছী বাগদাদী রঃ সূরা আম্বয়িার ১০৭ নং আয়াতের ব্যাখ্যায় উল্লেখ করেন,
ولذا كان نوره صلى الله عليه وسلم اول المخلوقات ففى الخبر اول ما خلق الله نور نبيك يا جابر.
“আর এ কারণেই তাঁর নূরানী সত্ত্বা সমস্থ মাখলুকাতের পূর্বে সৃষ্টি এবং এ কথাই হাদিস শরীফে আছে: হে জাবের! আল্লাহ তা’লা সর্বপ্রথম তোমার নবীর নূর সৃষ্টি করেছেন।”
সূত্রঃ তাফছিরে রুহুল মাআনী, ৯ম খন্ড, ১০০ পৃষ্ঠা।
হিজরী ১১ শতাব্দীর মোজাদ্দেদ আল্লামা মোল্লা আলী কারী হানাফী র: তদীয় কিতাবে বলেন, ان اولها النور الذى خلق منه عليه الصلاة والسلام “সর্বপ্রথম সৃষ্টি হল নবী পাক দঃ এর সেই নূর, যাকে আল্লাহ তা’লা সৃষ্টি করেছেন।”
সূত্রঃ মিরকাত শরহে মিশকাত, ১ম খন্ড, ২৪১ পৃষ্ঠা।
লা-মাযহাবীদের মাথার তাজ মাওলানা কাজী শাওকানী তার তদীয় কিতাবে উল্লেখ করেন, اول المسلمين اجمعين لانه وان كان متأخرا فى الرسالة فهو اولهم فى الخلق “ রাসূল দঃ সকল মুসলমানের মধ্যে সর্বপ্রথম মুসলমান। কেননা তিনি রাসুল হিসেবে সবার পর আবির্ভূত হলেও তিনি সৃষ্টির মধ্যে প্রথম।”
সূত্রঃ তাফছিরে ফাতহুল কাদিও,২য়খন্ড,২১১ প্রষ্ঠা।
আশরাফ আলী থানভী সাহেবের অন্যতম খলীফা ও তাফছিওে মারেফুল কুরআনের মোফাচ্ছির আল্লামা মুফতী শফী সাহেব (পাকিস্তান) তদীয় কিতাবে বলেন,
“প্রথম মুসলমান হওয়া দ্বারা এদিকেও ইঙ্গিত হতে পাওে যে, সৃষ্টি জগতের মাঝে সর্বপ্রথম রাসূলুল্লাহ দঃ এর নূর সৃষ্টি করা হয়েছে।”
সূত্রঃ তাফছিরে মারেফুল কুরআন, সৌদি নং ৪২৮ পৃষ্ঠা।
অতএব , উপরিউক্ত সকল আলোচনার দ্বারা প্রমানিত হলো যে, সকল সৃষ্টি হওয়ার পূর্বে সৃষ্টি হয়েছে কলম, এবং কলম সৃষ্টি হওয়ার পূর্বে সৃষ্টি হয়েছে আল্লাহর আরশ। আল্লাহর আরশ সৃষ্টি হওয়ার পূর্বে সৃষ্টি হয়েছে পানি। এমনকি পানি সৃষ্টি হওয়ার পূর্বে সৃষ্টি হয়েছে ‘নূরে মুহাম্মদী’। কেননা ছহীহ সনদে হযরত জাবের রাঃ থেকে বর্ণিত আছে,
عن جابر قال: قلت يا رسول الله بأبى انت وامى اخبرنى عن اول شىء خلقه الله قبل الشياء, فقال:ياجابر! ان الله خلق قبل الشياء نور نبيك من نوره فجعل ذلك النور يدور بالقدرة حيث شاء الله ولم يكن فى ذلك الوقت لوح ولا قلم ولا نار ولا ملك ولاسماء ولاارض ولاشمس ولا قمر ولا جنى ولا انس.
“হজরত জাবের আল আনছারী রাঃ বর্ণনা করেন, আমি রাসূলে পাক দঃ কে জিজ্ঞাসা করলাম আমার পিতা-মাতা আপনার কদমে কুরবান হউক ইয়া রাসুলাল্লাহ! আমাকে সংবাদ দিন আল্লাহ সব কিছুর পূর্বে কি সৃষ্টি করেছেন? প্রিয় নবিজী বললেন, হে জাবের ! নিশ্চয় আল্লাহ সব কিছুর পূর্বে তাঁর নূও থেকে তোমার নবীর নূর সৃষ্টি করেছেন। অতঃপর সেই নূর আল্লাহর কুদরতে পরিভ্রমন করতে থাকল যেভাবে আল্লাহ চেয়েছেন। তখন কোন ওয়াক্ত, লওহ-কলম, জান্নাত-জাহান্নাম,ফেরেস্থা,আসমান-জমীন, চন্দ্র-সূর্য, জ্বীন-ইনছান কেন কিছুই ছিলনা............।”
সুত্রঃ মুসান্নাফে আব্দুর রাজ্জাক এর যুযউল মাফকুদ,৬৩ পৃষ্ঠা। আদ দুরারুল বাহিয়্যাহ,৪-৮ পৃ: কৃত: আল্লামা ইমাম নববী। মাওয়াহেবুল লাদুন্নিয়া,১ম খন্ড,৭১ পৃষ্ঠা
No comments
Thanks for comment